মধ্যযুগে ইসলামি শিক্ষার সুবিধা ও অসুবিধা | Advantages and Disadvantages of Islamic Education in the Middle Ages (Class 11)

মধ্যযুগে ইসলামি শিক্ষার সুবিধা ও অসুবিধা – বেদকে কেন্দ্র করে যেমন বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তেমনই কোরানকে কেন্দ্র করে মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। কোরানে বলা হয়েছে, ইসলাম ধর্মপ্রচার প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। মুসলমানের এই কর্তব্যপালনকে সফল করে তোলার উদ্দেশ্যে মুসলমান শাসকগণ ভারতে মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এই শিক্ষা সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তাই ভারতবর্ষে মুসলিম শিক্ষার বিস্তার যথেষ্ট পরিমাণেই হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে একথা বলা যায় যে, মুসলিম যুগের শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই ছিল।

মধ্যযুগে ইসলামি শিক্ষার সুবিধা ও অসুবিধা

মধ্যযুগে ইসলামি শিক্ষার সুবিধা ও অসুবিধা
মধ্যযুগে ইসলামি শিক্ষার সুবিধা ও অসুবিধা

মধ্যযুগে ইসলামি শিক্ষার সুবিধা ও অসুবিধা

(1) মুসলিম যুগে ইসলামি শিক্ষার সুবিধা: 

মুসলিম যুগের শিক্ষার সুবিধা বা ইতিবাচক দিকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

  1. স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষা: মুসলিম যুগের মাদ্রাসার শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষা ছিল অবৈতনিক। প্রাথমিক শিক্ষা বা মক্তবের শিক্ষায় খুব কম বেতন নেওয়া হত।
  2. নৈতিক শিক্ষা: নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার ফলে তরুণদের মধ্যে নৈতিক জীবন সম্পর্কে একটা আকর্ষণ তৈরি হত।
  3. বাস্তব জীবনের উপযোগী শিক্ষা: বাস্তব প্রয়োজনীয়তাকে ভিত্তি করে এই শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠায় তা ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত কার্যকরী হয়ে ওঠে, পাশাপাশি সমাজেরও মঙ্গলসাধন হয়।
  4. বৈচিত্র্যপূর্ণ পাঠক্রম: ইসলামি যুগের পাঠক্রমে বৈচিত্র্য দেখা যেত। এর ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের আগ্রহ ও প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষার সুযোগ যেমন পেত, অন্যদিকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত লোকের যথেষ্ট সরবরাহ বজায় থাকত।
  5. শৃঙ্খলা: কোরান এবং ইসলামি অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের নির্দেশ অনুযায়ী শিক্ষাজীবন পরিচালিত হওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা দেখা যেত না।
  6. শিক্ষার প্রসার: শিক্ষার প্রসারের জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় মক্তব ও মাদ্রাসার প্রসার ঘটে। হিন্দু শিক্ষার প্রসার কিছুটা সংকুচিত হলেও টোল, পাঠশালা, চতুষ্পাঠী ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলি চালু থাকায় প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থাও চালু ছিল।
  7. ইতিহাস ও সাহিত্যের অগ্রগতি: মধ্য তথা ইসলামি যুগে ইতিহাস ও সাহিত্যের যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছিল। মুসলিম শাসকদের আত্মবিবরণীতে ইতিহাসের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্যে রাজদরবারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে স্থান দেওয়া হত। এই সময়কালের অনেক রচনায় সাহিত্যিক দক্ষতার ছাপ ছিল। শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, মুসলিম যুগ ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
  8. ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয়: সাধারণভাবে মুসলিম শাসকরা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা পছন্দ না করলেও ফিরোজ শাহ তুঘলক, আকবর প্রমুখ ইসলামীয় শাসক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন।

মধ্যযুগে হিন্দুদের শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত হলেও মহম্মদ-বিন-তুঘলক, আকবর, শাহজাহান প্রমুখ মুসলিম শাসকদের আমলে হিন্দু ও মুসলিম সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে এক অপূর্ব সমন্বয় গড়ে উঠেছিল, যার পরিচয় পাওয়া যায় স্থাপত্য শিল্পে এবং উর্দুভাষার বিকাশে। শাহজাহান-পুত্র দারাশিকোর অবদান এক্ষেত্রে অবিস্মরণীয়।

(2) মুসলিম যুগে ইসলামি শিক্ষার অসুবিধা: 

মুসলিম যুগের শিক্ষার অসুবিধা বা নেতিবাচক দিকগুলি হল-

  1. গণশিক্ষার অভাব: মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থায় গণশিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকার মক্তবের সংখ্যা যথেষ্ট থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের জন্য পাঠশালার সংখ্যা ছিল অল্প। তা ছাড়া বিত্তবানদের দানেই মক্তব এবং মাদ্রাসার ব্যয় চালানো হত। তাদের দান অনিয়মিত হলেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেত।
  2. হিন্দুদের শিক্ষার প্রতি অবহেলা: আকবর প্রমুখ অল্প দু-একজন মুসলিম শাসক ছাড়া অধিকাংশ মুসলমান শাসক তাঁদের চোখে ‘কাফের’ অর্থাৎ হিন্দুদের শিক্ষার প্রসারে কোনোরকম গুরুত্ব দেননি।
  3. মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা: প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষার পরিবর্তে ফারসি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত।
  4. নারীশিক্ষার প্রতি অবহেলা: পর্দাপ্রথা চালু হওয়ায় নারীশিক্ষা বাধাপ্রাপ্ত হয়। রাজা, মহারাজা এবং উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়েদের গৃহশিক্ষকের দ্বারা শিক্ষাদান করা হত, কিন্তু সাধারণ পরিবারের মেয়েদের এ সুযোগ ছিল না।
  5. সময়ের অপচয়: মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি হল পঠন ক্ষমতা একটা নির্দিষ্ট মানে পৌঁছোনোর পর লিখন শেখানো হত। এতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হত।
  6. অনুপযুক্ত পাঠক্রম: বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠক্রমের আধুনিকীকরণ হত না।
  7. কঠোর শাস্তি: সামান্য কারণেও শিক্ষার্থীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার রেওয়াজ চালু ছিল। এর ফলে লেখাপড়ার প্রতি শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহের অভাব দেখা যেত।
  8. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনিশ্চয়তা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সরকারি আনুকূল্য এবং বিত্তবানদের দানে পরিচালিত হত। কোনো কারণে অর্থের উৎস বন্ধ হলেই প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হয়ে যেত। এ ধরনের ঘটনা মুসলিম যুগে অহরহ ঘটত।
  9. বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব: মুসলিম যুগে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষার খুব অভাব ছিল।

যুদ্ধবিগ্রহ: মুসলিম যুগে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। অধিকাংশ রাজা এবং সম্রাট অধিকৃত অঞ্চল রক্ষায় এবং সাম্রাজ্যবিস্তারে ব্যস্ত থাকতেন। অনেকেই বিদ্যার প্রতি আগ্রহী হলেও দেশের শিক্ষাবিস্তারে তেমন মনোযোগ দিতে পারতেন না। এর ফলে শিক্ষার আশানুরূপ বিকাশ কখনোই ঘটেনি।

To know More – www.wbnote.com

Leave a Comment